বিশ শতকের ভারতে কৃষক, শ্রমিক ও বামপন্থী আন্দোলন: বৈশিষ্ট্য ও আলোচনা

বিশ শতকের ভারতে কৃষক, শ্রমিক ও বামপন্থী আন্দোলন: বৈশিষ্ট্য ও আলোচনা

ভারতে কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে জাতীয় কংগ্রেস ও বামপন্থী রাজনীতির সংযোগ
ভারতে শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে জাতীয় কংগ্রেস ও বামপন্থী রাজনীতির সংযোগ
ভারতে উপনিবেশ-বিরোধী আন্দোলনে বামপন্থী রাজনীতি

বহুনির্বাচনী প্রশ্ন (MCQ)

1.’একা’ আন্দোলনের নেতা ছিলেন-

(A) মাদারি পাসি (B) ডঃ আম্বেদকর (c) মহাত্মা গান্ধি (D) বাবা রামচন্দ্র, Ans. (A) মাদারি পাসি

2.নিখিল ভারত ট্রেড ইউনিয়ান কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা হয়েছিল-

(A) ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে (B) ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে (৩) ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে (০) ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে, Ans. (B) ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে 

3.বারদৌলি সত্যাগ্রহ হয়েছিল-

(A) বোম্বাই-এ (B) পাঞ্জাবে (C) মাদ্রাজে (D) গুজরাটে, Ans.  (D) গুজরাটে

4.বয়কট আন্দোলনের ফলে অর্থনৈতিক দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল- 

(A) বাংলার কৃষক শ্রেণি (B) মধ্যবিত্ত শ্রেণি (C) জমিদার শ্রেণি (D) ছাত্রসমাজ, Ans. (A) বাংলার কৃষক শ্রেণি 

5.বাবা রামচন্দ্র কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন-

(A) বিহারে (B) যুক্তপ্রদেশে (C) রাজস্থানে (D) মহারাষ্ট্রে, Ans. (B) যুক্তপ্রদেশে

সংক্ষিপ্ত উত্তর প্রশ্ন (SAQ)

1.নিখিল ভারত ট্রেড ইউনিয়ান কংগ্রেস কী উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল?

উত্তর: ১১২০ খ্রিস্টাব্দে লালা লাজপত রায়ের সভাপতিত্বে বোম্বাইতে নিখিল ভারত ট্রেড ইউনিয়ান কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যগুলি হল-

(i) ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে শ্রমিক আন্দোলনের কার্যকলাপকে নিয়ন্ত্রিত ও সুসংবদ্ধ করা।

(ii) বিভিন্ন অঞ্চলে ব্রিটিশ বিরোধী শ্রমিক আন্দোলন ছড়িয়ে দেওয়া,

(iii) শ্রমিক শ্রেণির আর্থ-সামাজিক উন্নতি সাধন করা এবং

(iv) শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার জাগরণ ঘটানো প্রভৃতি।

2.বারদৌলি সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু হয় কেন? 

উত্তর: ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে গুজরাটের সুরাট জেলার বারদৌলি তালুকের কৃষকরা বল্লভভাই প্যাটেলের নেতৃত্বে বৃহত্তর সত্যাগ্রহ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। নিম্নবর্ণের কৃষক ‘কালিপরাজ’দের উপর উচ্চবর্ণের কৃষক ‘উজালিপরাজ’দের অত্যাচারে কৃষকরা বিক্ষুব্ধ ছিল। এই প্রেক্ষাপটে ব্রিটিশ সরকারের রাজস্বের পরিমাণ পূর্বাপেক্ষা ২৭ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করার পাশাপাশি, আন্তর্জাতিক বাজারে তুলোর দাম পড়ে গেলে এবং জলসেচের সংকট দেখা দিলে কৃষকরা ক্ষোভে ফেটে পড়ে।

3.১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের ‘শিল্পবিরোধ বিল’ ও ‘জননিরাপত্তা বিলে’ কী বলা হয়েছিল?/ভারতীয়রা এই বিল দুটির বিরোধিতা করেছিল কেন?

উত্তর: ভারতে কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে শ্রমিক আন্দোলনের বিপুল অগ্রগতি স্তব্ধ করার লক্ষ্যে ব্রিটিশ সরকার ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে ‘শিল্পবিরোধ বিল’ ও ‘জননিরাপত্তা বিল’ নামে দুটি দমনমূলক আইন পাশ করে। প্রথম বিলটির দ্বারা শ্রমিক ধর্মঘট নিষিদ্ধ হয় এবং ধর্মঘটকে রাজদ্রোহ বলে ঘোষণা করা হয়। দ্বিতীয় বিলটির দ্বারা শ্রমিক সংগঠকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়। পুলিশ বিনাপরোয়ানায় গ্রেপ্তার এবং বিনা বিচারে আটক রাখার অধিকার পায়।

দীর্ঘ উত্তর প্রশ্ন (LAQ)

1.টীকা লেখো: ‘একা’ আন্দোলন।

উত্তর: গান্ধিজির নেতৃত্বে অহিংস-অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে (১৯২১-২২) যুক্তপ্রদেশের হরদৈ, বারাবাঁকি, সীতাপুর, বারাইচ প্রভৃতি অঞ্চলে যে কৃষক অভ্যুত্থান ঘটে, ইতিহাসে তা ‘একা’ বা একতা আন্দোলন নামে পরিচিতি পেয়েছে।

নামকরণ: আন্দোলন চলাকালে যেকোনো অবস্থায় কৃষকরা ঐক্যবন্ধ থাকার শপথ নেয়। তাই এই আন্দোলনের এইরূপ নামকরণ।

কারণ: কুষকদের ওপর অতিরিক্ত ৫০% করারোপ, অনাদায়ে অত্যাচার, জমি বাজেয়াপ্তকরণ, বেগার শ্রমদান প্রথা প্রভৃতি কৃষকদের বিদ্রোহের পথে পরিচালিত করেছিল।

নেতৃত্ব: মাদারি পাসি নামে অনুন্নত সম্প্রদায়ের এক নেতাই ছিলেন আন্দোলনের মূল চালিকা শক্তি। এছাড়াও বাবা গরিবদাস প্রমুখ এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

শপথনামা: মাদারি পাসির নেতৃত্বে অনুন্নত সম্প্রদায়ের কৃষকরা দলে দলে এই আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়ে। মন্ত্রপাঠ ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কৃষকরা শপথ নেয় যে-

(i) নির্দিষ্ট সময়ে নির্ধারিত খাজনা ছাড়া তারা অতিরিক্ত দোনো কর দেবে না,

(ii) জমি থেকে উচ্ছেদ করা হলেও তারা জমি ছাড়বে না, 

(iii) রশিদ ছাড়া খাজনা দেবে না।

(iv) খাজনা দেবে নগদ টাকায়, শস্যের মাধ্যমে নয়,

(v) জমিদারের জমিতে বেগার খাটবে না,

(vi) গ্রাম্য বিবাদের মীমাংসা হবে পঞ্চায়েতের মাধ্যমে এবং

(vii) সর্বক্ষেত্রে কৃষকরা ঐক্য বজায় রাখবে।

জাতীয় কংগ্রেসের ভূমিকা: আন্দোলনের সূচনাপর্বে কংগ্রেসী নেতৃবৃন্দ এর সঙ্গে যুক্ত থাকলেও আন্দোলন ক্রমে হিংসাত্মক হয়ে উঠলে কংগ্রেস আন্দোলন থেকে বেরিয়ে যায়।

বৈপ্লবিক কর্মকান্ড: আন্দোলন ক্রমে সশস্ত্র রূপ পরিগ্রহ করে। জমিদার ও তালুকদারদের ঘরবাড়ি ও খামার আক্রান্ত হয় এবং কুমায়ুন অঞ্চলের হাজার হাজার মাইল সংরক্ষিত অরণ্যে ‘অগ্নি-সংযোগ করা হয়। মাদারি পাসি তাঁর অনুগামীদের স্থানীয় জেলাশাসককে হত্যা করতেও ইন্ধন দেন।

অবসান: আন্দোলনের ব্যাপকতায় আতঙ্কিত ব্রিটিশ সরকার চন্ডনীতির মাধ্যমে আন্দোলন দমনে উদ্যোগী হয়। শেষপর্যন্ত ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে মাদারি পাসির গ্রেপ্তার এবং অনুচরবর্গের নিষ্ঠুর হত্যার মধ্যে দিয়ে ব্রিটিশ সরকার এই বিদ্রোহ দমন করে।

মন্তব্য ব্যর্থ হলেও ভারতের অগণিত কৃষক বিদ্রোহের ভিড়ে ‘একা’ আন্দোলন এক স্বতন্ত্র স্থানের অধিকারী।

2.অহিংস অসহযোগ আন্দোলনে কৃষক সমাজ কীভাবে অংশগ্রহণ করেছিল?

উত্তর: কৃষক সমাজের সার্বিক তথা স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।

অহিংস অসহযোগ আন্দোলনে কৃষক সমাজের সর্বভারতীয় অংশগ্রহণ

বাংলা : গান্ধিজির অসহযোগের মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে বাংলার কৃষক সমাজ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

(ক) ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে বীরেন্দ্রনাথ শাঁসমলের নেতৃত্বে মেদিনীপুরের কাঁথি ও তমলুক মহকুমায় ইউনিয়ান বোর্ড বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। (খ) ১৯২১-২২ খ্রিস্টাব্দে পাবনা, বগুড়া ও বীরভূমে সরকারি জমি জরিপের কাজে বাধা দেওয়া হয়। বীরভূমে এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন জিতেন্দ্রলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। (গ) রাজশাহীতে নীলচাষের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন সোমেশ্বর প্রসাদ চৌধুরী। (ঘ) কুমিল্লা, রাজশাহী, রংপুর ও দিনাজপুরে মুসলিম কৃষকদের অংশগ্রহণে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে।

উত্তরপ্রদেশঃ (ক) গান্ধিজির নেতৃত্বে অহিংস-অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে যুক্তপ্রদেশের হরদৈ, বারাবাঁকি, সীতাপুর, বারাইচ প্রভৃতি অঞ্চলে যে কৃষক অভ্যুত্থান ঘটে, ইতিহাসে তা ‘একা’ বা একতা আন্দোলন নামে পরিচিতি পেয়েছে। আন্দোলন চলাকালে যেকোনো অবস্থায় কৃষকরা ঐক্যবদ্ধ থাকার শপথ নেয়। তাই এই আন্দোলনের এইরূপ নামকরণ। মাদারি পাসি নামে অনুন্নত সম্প্রদায়ের এক নেতাই ছিলেন আন্দোলনের মূল চালিকা শক্তি।

(খ) বাবা রামচন্দ্র নামে জনৈক সন্ন্যাসীর নেতৃত্বে ১৯২০খ্রিস্টাব্দ নাগাদ যুক্তপ্রদেশের প্রতাপগড় ও রায়বেরিলি অঞ্চলে কৃষক অভ্যুত্থান ঘটে। ওই বছরই বাবা রামচন্দ্র প্রতাপগছে অযোধ্যা কিষাণ সভা প্রতিষ্ঠা করেন। আন্দোলনের চাপে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে সরকার ‘অযোধ্যা খাজনা আইন’ পাস করে করভার কিছুটা লাঘব করতে বাধ্য হয়।

বিহার: ১৯১৯-২০ খ্রিস্টাব্দে বিহারের দ্বারভাঙা, মজফ্ফরপুর, ভাগলপুর, পূর্ণিয়া ও মুঙ্গেরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে দ্বারভাঙার মহারাজার বিরুদ্ধে কৃষক বিদ্রোহ শুরু হয়।

রাজস্থান: (ক) নানাধরনের উপকর ও সামন্ততান্ত্রিক শোষণের বিরুদ্ধে অসহযোগ পর্বে মেবারের বিজোলিয়া অঞ্চলে বিজয় সিং পথিক ও মানিকলাল বর্মার নেতৃত্বে কৃষক আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে। আন্দোলনকারীরা ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে তাদের কিছুটা দাবি আদায়ে সক্ষম হয়।

(খ) ১৯২১-২২ খ্রিস্টাব্দে মতিলাল তেজওয়াত মেবারের ভীল সহ উপজাতিদের সংগঠিত করে আন্দোলনে শামিল হন।

দক্ষিণ ভারতঃ (ক) অস্ত্রের গুন্টুর জেলার পালনাদ তালুক ও কুড্ডাপার রায়চটি তালুকের উপজাতি সম্প্রদায়ভুক্ত গরিব চাষিরা তাদের অরণ্যের অধিকার রক্ষার জন্য অরণ্য সত্যাগ্রহ গড়ে তোলে।

(খ) অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে দক্ষিণ ভারতে সর্বাপেক্ষা ব্যাপক ও ভয়াবহ কৃষক আন্দোলনটি সংঘটিত হয়েছিল ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে মালাবার উপকূলে, যা মোপলা বিদ্রোহ নামে পরিচিত। অনেকক্ষেত্রে এই বিদ্রোহ হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় পর্যবসিত হলেও এর মূল চরিত্র ছিল সামন্ততন্ত্র-বিরোধী।

মন্তব্য অসহযোগ আন্দোলনের সময় থেকে প্রকৃতপক্ষে কৃষক আন্দোলন ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের অবিচ্ছেদ্য অলো পরিণত হয়েছিল।





Scroll to Top