লামার্কবাদের তত্ত্ব (Lamarckism) – বিবর্তন সংক্রান্ত ধারণা

ভূমিকা

বিবর্তন জীববিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা, যা প্রাণীদের ধীরে ধীরে পরিবর্তনের মাধ্যমে নতুন বৈশিষ্ট্য অর্জনের প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করে। ফরাসি জীববিজ্ঞানী জ্যাঁ ব্যাপ্টিস্ট লামার্ক (Jean Baptiste Lamarck) 1809 সালে প্রথম বিবর্তনের একটি পূর্ণাঙ্গ তত্ত্ব প্রস্তাব করেন, যা ‘লামার্কবাদ’ (Lamarckism) নামে পরিচিত। তাঁর মতে, পরিবেশের প্রভাব, অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ব্যবহার ও অব্যবহার, এবং অর্জিত বৈশিষ্ট্যের উত্তরাধিকার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নতুন প্রজাতির সৃষ্টি হয়।

এই প্রবন্ধে, লামার্কের বিবর্তন তত্ত্বের প্রধান চারটি নীতি আলোচনা করা হবে—

  1. পরিবেশের প্রভাব (Influence of the Environment)
  2. অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ব্যবহার ও অব্যবহারের নীতি (Law of Use and Disuse of Organs)
  3. অর্জিত বৈশিষ্ট্যের উত্তরাধিকার (Law of Inheritance of Acquired Characters)
  4. নতুন প্রজাতির উদ্ভব (Origin of New Species)

 

১. পরিবেশের প্রভাব (Influence of the Environment)

লামার্কের মতে, পরিবেশ পরিবর্তনের ফলে জীবের গঠন, আচরণ ও বৈশিষ্ট্যে পরিবর্তন ঘটে। যখন কোনো প্রাণী তার পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করে, তখন তার দেহে কিছু পরিবর্তন দেখা যায়, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সঞ্চারিত হতে পারে।

 

উদাহরণ:

  • মরুভূমির ক্যাকটাস জল সংরক্ষণের জন্য পাতা পরিবর্তন করে কাঁটায় রূপান্তরিত করেছে।
  • জলজ প্রাণী মাছের মতো শরীর গঠন করে দ্রুত চলাচলের জন্য অভিযোজিত হয়েছে।

 

পরিবেশ পরিবর্তন প্রাণীর অভিযোজন
শুষ্ক জলবায়ু পাতার পরিবর্তে কাঁটা (ক্যাকটাস)
জলজ পরিবেশ ভরাট শরীর ও পাখনা (মাছ)
উষ্ণ জলবায়ু লম্বা ও পাতলা শরীর (উট)

 

২. অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ব্যবহার ও অব্যবহারের নীতি (Law of Use and Disuse of Organs)

লামার্কের মতে, যদি কোনো অঙ্গ বেশি ব্যবহৃত হয়, তাহলে তা ক্রমশ উন্নত ও শক্তিশালী হয়। আবার, কম ব্যবহৃত হলে সেটি ক্রমশ ক্ষীণ বা বিলুপ্ত হয়ে যায়।

উদাহরণ:

  • জিরাফের লম্বা গলা: প্রাথমিকভাবে জিরাফের গলা ছিল ছোট, কিন্তু তারা উঁচু গাছের পাতা খাওয়ার জন্য গলা প্রসারিত করতে থাকে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই বৈশিষ্ট্য আরো বিকশিত হয় এবং আধুনিক জিরাফের গলা দীর্ঘ হয়েছে।
  • অন্ধ গুহাচিপি মাছ (Cavefish): অন্ধকার গুহায় বসবাসরত কিছু মাছের চোখের ব্যবহার না থাকায় ক্রমশ তা ক্ষুদ্র হয়ে গেছে বা বিলুপ্ত হয়েছে।

 

অঙ্গের ব্যবহার পরিণতি
অধিক ব্যবহৃত অঙ্গ শক্তিশালী ও সুগঠিত হয়
অব্যবহৃত অঙ্গ দুর্বল বা বিলুপ্ত হয়ে যায়

৩. অর্জিত বৈশিষ্ট্যের উত্তরাধিকার (Law of Inheritance of Acquired Characters)

লামার্কের মতে, কোনো প্রাণীর জীবনকালে অর্জিত বৈশিষ্ট্য তার পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে সঞ্চারিত হয়।

উদাহরণ:

  • একজন নরসুন্দর বা ধাতুবিদ তার হাতের পেশি বেশি ব্যবহার করায় শক্তিশালী হয়। লামার্কের মতে, এই বৈশিষ্ট্য তার সন্তানদের মধ্যেও প্রবাহিত হতে পারে।
  • পরিবর্তিত পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে গাছপালা ও প্রাণীরা তাদের দেহের গঠন পরিবর্তন করে এবং এই পরিবর্তন উত্তরাধিকার সূত্রে পরবর্তী প্রজন্মে পৌঁছে যায়।
অর্জিত বৈশিষ্ট্য পরবর্তী প্রজন্মে সঞ্চার
শক্তিশালী হাতের পেশি হস্তশিল্পীদের সন্তানদের শক্তিশালী হাত
লম্বা গলা (জিরাফ) পরবর্তী প্রজন্মের দীর্ঘ গলা

তবে, আধুনিক জীববিজ্ঞান প্রমাণ করেছে যে অর্জিত বৈশিষ্ট্য জেনেটিক উপায়ে পরবর্তী প্রজন্মে স্থানান্তরিত হয় না।

 

৪. নতুন প্রজাতির উৎপত্তি

ল্যামার্কের মতে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে অর্জিত বৈশিষ্ট্যগুলির ধাপে ধাপে সঞ্চয়ের ফলে নতুন প্রজাতির সৃষ্টি হয়। পরিবেশের পরিবর্তনের সাথে সাথে জীবগুলি নতুনভাবে অভিযোজিত হতে থাকে, এবং একসময় তারা তাদের পূর্বপুরুষদের থেকে এতটাই আলাদা হয়ে যায় যে, তারা একেবারে আলাদা একটি প্রজাতিতে পরিণত হয়।

উদাহরণ:

  • জিরাফরা প্রাচীনকালে ছোট গলার পূর্বপুরুষ থেকে দীর্ঘ গলা অর্জনের মাধ্যমে বিবর্তিত হয়েছে। 
  • তিমির মতো জলজ স্তন্যপায়ী প্রাণীরা সম্ভবত স্থলজ পূর্বপুরুষ থেকে বিবর্তিত হয়েছে, যারা জলে জীবনযাপনে অভিযোজিত হয়েছিল। 
মূল জীব অভিযোজিত নতুন রূপ
স্থলজ স্তন্যপায়ী প্রাণী জলজ স্তন্যপায়ী প্রাণী (যেমন: তিমি)
ছোট গলা-যুক্ত জিরাফ দীর্ঘ গলা-যুক্ত জিরাফ

ল্যামার্কবাদের সীমাবদ্ধতা

যদিও ল্যামার্কের তত্ত্ব ছিল প্রগতিশীল ও যুগান্তকারী, আধুনিক বিজ্ঞান তার অনেক ধারণাকে ভুল প্রমাণ করেছে। জিনতত্ত্ব ও ডিএনএ অনুসন্ধানের মাধ্যমে জানা যায় যে, শুধুমাত্র জেনেটিক পরিবর্তন (mutation) এবং প্রাকৃতিক নির্বাচন (natural selection)-ই বিবর্তনের প্রকৃত চালিকা শক্তি। অর্জিত বৈশিষ্ট্য উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত হয় না।

ল্যামার্কের ধারণা আধুনিক বিজ্ঞান অনুযায়ী সত্য
অর্জিত বৈশিষ্ট্য উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত হয় শুধুমাত্র জিনগত বৈশিষ্ট্য উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত হয়
জীব তার জীবদ্দশায় অভিযোজিত হয় অভিযোজন ঘটে প্রজন্ম ধরে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে

ল্যামার্কের বিবর্তন তত্ত্ব ছিল প্রজাতির পরিবর্তন ব্যাখ্যা করার অন্যতম প্রাথমিক প্রচেষ্টা। যদিও তার কিছু অংশ যেমন পরিবেশের প্রভাব এখনও গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয়, তথাপি অর্জিত বৈশিষ্ট্য উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়ার ধারণাটি আজ বাতিল হয়ে গেছে। তার পরিবর্তে এখন ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচনের তত্ত্ব এবং আধুনিক জিনতত্ত্বকে বিবর্তনের মূল ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়।

তবে সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও, ল্যামার্কবাদ বিবর্তনীয় জীববিদ্যার পথপ্রদর্শক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এবং পরবর্তী বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ভিত্তি স্থাপন করেছে।

 

Scroll to Top