চোখের বিভিন্ন অংশের গঠন ও ভূমিকা

চোখের বিভিন্ন অংশের গঠন ও ভূমিকা

ভূমিকা

মানুষের চোখ একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল ও জটিল ইন্দ্রিয় অঙ্গ, যা দৃষ্টিশক্তির জন্য দায়ী। এটি আলো গ্রহণ করে, তা বৈদ্যুতিক সংকেতে রূপান্তরিত করে এবং অপটিক স্নায়ুর মাধ্যমে মস্তিষ্কে প্রেরণ করে। চোখের বিভিন্ন অংশের মধ্যে সমন্বয় থাকার ফলে আমরা বস্তুর আকার, রঙ এবং গভীরতা দেখতে পারি।

এই নিবন্ধে, আমরা শ্বেতপর্দা (Sclera), কর্নিয়া (Cornea), কোরয়েড (Choroid), আইরিস (Iris), রেটিনা (Retina), অ্যাকুয়াস হিউমার (Aqueous Humour), লেন্স (Lens), ভিট্রিয়াস হিউমার (Vitreous Humour), কনজাংটিভা (Conjunctiva), চোখের পাতা (Eyelids) ও অশ্রু গ্রন্থি (Tear Glands) সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করবো।

১. শ্বেতপর্দা (Sclera) – চোখের রক্ষাকবচ

গঠন:

  • এটি চোখের সবচেয়ে বাইরের স্তর, যা শক্ত ও ফাইব্রাস টিস্যু দিয়ে তৈরি।
  • এটি চোখের বলকে রক্ষা করে এবং তার গঠন বজায় রাখে।

ভূমিকা:

  • চোখের আকৃতি বজায় রাখে এবং ভিতরের অংশগুলিকে রক্ষা করে।
  • চোখের গতি নিয়ন্ত্রণকারী পেশিগুলোর সংযোজন বিন্দু হিসেবে কাজ করে।

২. কর্নিয়া (Cornea) – চোখের স্বচ্ছ পর্দা

গঠন:

  • এটি চোখের সামনের স্বচ্ছ স্তর, যা আলো প্রবেশের পথ তৈরি করে।
  • এতে রক্তনালী নেই, তবে এটি অশ্রু ও অ্যাকুয়াস হিউমার থেকে পুষ্টি গ্রহণ করে

ভূমিকা:

  • আলো প্রবেশ করিয়ে তা রেটিনার দিকে কেন্দ্রীভূত করে।
  • চোখকে বাইরের ধুলো ও জীবাণুর হাত থেকে রক্ষা করে

৩. কোরয়েড (Choroid) – চোখের রক্তনালীর স্তর

গঠন:

  • এটি একটি গাঢ় রঙের স্তর, যা শ্বেতপর্দা ও রেটিনার মধ্যে অবস্থিত।
  • এতে রক্তনালী থাকে, যা রেটিনাকে অক্সিজেন ও পুষ্টি সরবরাহ করে।

ভূমিকা:

  • রেটিনাকে পুষ্টি প্রদান ও দৃষ্টিশক্তি ঠিক রাখার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ
  • চোখের অভ্যন্তরে অতিরিক্ত আলো শোষণ করে, যাতে প্রতিফলন না হয়।

৪. আইরিস (Iris) – চোখের রঙিন অংশ

গঠন:

  • এটি একটি বৃত্তাকার, পিগমেন্টযুক্ত পেশী, যা চোখের রঙ নির্ধারণ করে।
  • এর কেন্দ্রে একটি ছিদ্র থাকে, যাকে মণি (Pupil) বলে

ভূমিকা:

  • আলো নিয়ন্ত্রণ করে, যাতে প্রয়োজন অনুযায়ী মণি ছোট বা বড় হয়।
  • তীব্র আলোতে মণি সংকুচিত হয়, আর কম আলোতে মণি প্রশস্ত হয়

৫. রেটিনা (Retina) – চোখের আলোক-সংবেদনশীল স্তর

গঠন:

  • এটি চোখের সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ স্তর, যেখানে আলোক-সংবেদনশীল কোষ (Rod ও Cone) থাকে।
  • Rod কোষ কম আলোতে দৃষ্টি শক্তি প্রদান করে এবং Cone কোষ রঙ চেনার ক্ষমতা প্রদান করে।

 

ভূমিকা:

  • আলোকে বৈদ্যুতিক সংকেতে রূপান্তরিত করে এবং মস্তিষ্কে পাঠায়।
  • বস্তুর রঙ, আকার ও গভীরতা শনাক্ত করতে সাহায্য করে

৬. অ্যাকুয়াস হিউমার (Aqueous Humour) – চোখের তরল পদার্থ

গঠন:

  • এটি একটি স্বচ্ছ, জলে পূর্ণ তরল, যা কর্নিয়া ও লেন্সের মধ্যবর্তী স্থানে থাকে।

ভূমিকা:

  • চোখের অভ্যন্তরীণ চাপ বজায় রাখে
  • কর্নিয়া ও লেন্সকে পুষ্টি সরবরাহ করে

৭. লেন্স (Lens) – আলোকে ফোকাস করার মাধ্যম

গঠন:

  • এটি একটি স্বচ্ছ, দ্বি-উত্তল গঠন, যা আইরিসের পিছনে থাকে।
  • এটি সাসপেনসরি লিগামেন্ট দ্বারা সংযুক্ত থাকে।

ভূমিকা:

  • আলোকে রেটিনার উপর সঠিকভাবে ফোকাস করতে সাহায্য করে
  • নিয়ার ও ডিস্ট্যান্স ভিশন সামঞ্জস্য করতে পারে (Accommodation)।

৮. ভিট্রিয়াস হিউমার (Vitreous Humour) – চোখের অভ্যন্তরীণ জেল

গঠন:

  • এটি একটি স্বচ্ছ, জেল-সদৃশ পদার্থ, যা লেন্স ও রেটিনার মধ্যে থাকে।

ভূমিকা:

  • চোখের গঠন বজায় রাখে
  • আলোকে বাধাহীনভাবে রেটিনার দিকে প্রবাহিত হতে সাহায্য করে

৯. কনজাংটিভা (Conjunctiva) – চোখের সুরক্ষার পর্দা

গঠন:

  • এটি একটি পাতলা, স্বচ্ছ ঝিল্লি, যা শ্বেতপর্দা ও চোখের পাতার ভেতরের অংশ আবৃত করে।

ভূমিকা:

  • চোখকে বাইরের জীবাণু ও ধুলাবালি থেকে রক্ষা করে
  • চোখকে আর্দ্র রাখে এবং শুষ্কতা প্রতিরোধ করে

১০. চোখের পাতা (Eyelids) – চোখের প্রতিরক্ষামূলক স্তর

গঠন:

  • এটি ত্বক, পেশী ও গ্রন্থি দ্বারা গঠিত এবং চোখের উপরিভাগ ঢেকে রাখে।

ভূমিকা:

  • চোখকে ধুলো, আলো ও আঘাত থেকে রক্ষা করে
  • অশ্রু ছড়িয়ে দিয়ে কর্নিয়াকে আর্দ্র রাখে

১১. অশ্রু গ্রন্থি (Tear Glands) – চোখের আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণকারী গ্রন্থি

গঠন:

  • এটি চোখের উপরের বাহ্যিক কোণ বরাবর অবস্থিত ছোট গ্রন্থি

 

ভূমিকা:

  • অশ্রু উৎপন্ন করে, যা চোখকে আর্দ্র রাখে।
  • চোখ পরিষ্কার রাখে এবং সংক্রমণ প্রতিরোধ করে

চোখের প্রতিটি অংশ একে অপরের সাথে সমন্বয় রেখে কাজ করে, যাতে আমরা বিশ্বকে স্পষ্টভাবে দেখতে পারি। কর্নিয়া ও লেন্স আলোকে ফোকাস করে, আইরিস আলো প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করে, রেটিনা আলোর সংকেত গ্রহণ করে এবং অপটিক নার্ভ মস্তিষ্কে সেই সংকেত পাঠায়।

চোখের যত্ন নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি আমাদের দৃষ্টিশক্তি বজায় রাখার জন্য অপরিহার্য। নিয়মিত চক্ষু পরীক্ষা এবং সঠিক পরিচর্যা চোখের স্বাস্থ্য সুরক্ষিত রাখতে সাহায্য করবে।

Scroll to Top