ভূমিকা
উদ্ভিদজনিত বংশগতি (Vegetative Propagation) হলো এক ধরনের অযৌন প্রজনন প্রক্রিয়া, যেখানে উদ্ভিদ বীজ ছাড়াই মূল, কান্ড বা পাতার মাধ্যমে নতুন গাছ তৈরি করে। এই পদ্ধতিতে গাছের বংশধর সম্পূর্ণরূপে মাতৃগাছের সদৃশ হয়, যা নির্দিষ্ট গুণাবলী সংরক্ষণে সাহায্য করে। এটি প্রাকৃতিকভাবে ঘটতে পারে অথবা কৃত্রিম উপায়ে উদ্যানচর্চার মাধ্যমে সম্পন্ন করা যায়। এই প্রবন্ধে আমরা প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম উদ্ভিদজনিত বংশগতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।
ক. প্রাকৃতিক উদ্ভিদজনিত বংশগতি
প্রাকৃতিকভাবে উদ্ভিদের নির্দিষ্ট অংশ যেমন মূল, কান্ড এবং পাতা থেকে নতুন উদ্ভিদ জন্ম নিতে পারে। এই প্রক্রিয়াটি উদ্ভিদকে দ্রুত ও কার্যকরভাবে বংশবিস্তারে সাহায্য করে।
১. মূলের মাধ্যমে বংশগতি
কিছু উদ্ভিদের মূল অংশে উপস্থিত কুঁড়ি (bud) থেকে নতুন উদ্ভিদ জন্মায়। যেমন:
- মিষ্টি আলু (Ipomoea batatas): মূলকন্দ (root tuber) থেকে নতুন গাছ জন্মায়।
- ডালিয়া (Dahlia): ফোলা শিকড় থেকে নতুন উদ্ভিদের বিকাশ ঘটে।
২. কান্ডের মাধ্যমে বংশগতি
কিছু উদ্ভিদের পরিবর্তিত কান্ড নতুন গাছ উৎপাদনে সাহায্য করে। যেমন:
- রাইজোম (Rhizome) – আদা, হলুদ: মাটির নিচে বেড়ে ওঠা কান্ড থেকে নতুন চারা জন্মায়।
- রানার (Runner) – স্ট্রবেরি, ঘাস: মাটির উপরিতলে বেড়ে ওঠা সরু কান্ড থেকে নতুন উদ্ভিদ জন্মায়।
- বাল্ব (Bulb) – পেঁয়াজ, রসুন: ফোলা কান্ডের পাতার স্তর থেকে নতুন উদ্ভিদ তৈরি হয়।
- টিউবার (Tuber) – আলু: কন্দের চোখ (buds) থেকে নতুন গাছ গজায়।
৩. পাতার মাধ্যমে বংশগতি
কিছু উদ্ভিদে পাতার নির্দিষ্ট অংশ থেকে নতুন চারা জন্মাতে পারে। যেমন:
- ব্রায়োফিলাম (Bryophyllum): পাতার প্রান্তে ছোট কুঁড়ি তৈরি হয় যা পরে মাটিতে পড়ে নতুন গাছে পরিণত হয়।
- বেগোনিয়া (Begonia): পাতার অংশ থেকে নতুন উদ্ভিদের বিকাশ ঘটে।
খ. কৃত্রিম উদ্ভিদজনিত বংশগতি
কিছু উদ্ভিদ বীজ থেকে জন্মাতে সমস্যা সৃষ্টি করে বা বীজ উৎপাদন করে না। সেক্ষেত্রে কাটিং, গ্রাফটিং ও মাইক্রোপ্রোপাগেশন পদ্ধতির মাধ্যমে উদ্ভিদের বংশগতি ঘটানো হয়।
১. কাটিং (Cutting)
এই পদ্ধতিতে উদ্ভিদের মূল, কান্ড বা পাতা কেটে মাটিতে রোপণ করা হয়, যা পরে শিকড় গজিয়ে নতুন উদ্ভিদ তৈরি করে।
- কান্ড কাটিং (Stem Cutting) – গোলাপ, হিবিসকাস, আখ: সুস্থ কান্ড কেটে মাটিতে পুঁতলে শিকড় গজায়।
- মূল কাটিং (Root Cutting) – তেঁতুল, লেবু: মূলের অংশ কেটে নতুন উদ্ভিদ তৈরি করা যায়।
- পাতা কাটিং (Leaf Cutting) – স্নেক প্ল্যান্ট, ব্রায়োফিলাম: পাতা বা পাতার অংশ থেকে নতুন গাছ জন্মায়।
২. গ্রাফটিং (Grafting)
এই পদ্ধতিতে দুটি আলাদা উদ্ভিদের অংশ একত্রে যুক্ত করে নতুন উদ্ভিদ তৈরি করা হয়।
- সায়ন (Scion): উপরের অংশ, যা শাখা-প্রশাখা গঠন করে।
- স্টক (Stock): নিম্নাংশ, যা শিকড় গঠনে সাহায্য করে।
গ্রাফটিং-এর প্রকারভেদ:
- হুইপ গ্রাফটিং (Whip Grafting) – আম, আপেল: সায়ন ও স্টককে তির্যকভাবে কেটে সংযুক্ত করা হয়।
- টাং গ্রাফটিং (Tongue Grafting) – কমলালেবু, পেয়ারা: উভয় অংশে চেরা কেটে সংযুক্ত করা হয়।
- অ্যাপ্রোচ গ্রাফটিং (Approach Grafting) – আঙুর, চামেলি: দুটি জীবন্ত উদ্ভিদকে সংযুক্ত করে গ্রাফটিং করা হয়।
৩. মাইক্রোপ্রোপাগেশন (Micropropagation)
এটি একটি আধুনিক টিস্যু কালচার পদ্ধতি, যেখানে উদ্ভিদের ক্ষুদ্র কোষ বা টিস্যু বিশেষ পুষ্টিসমৃদ্ধ মাধ্যমে বৃদ্ধি পায় এবং দ্রুত নতুন গাছ তৈরি হয়।
মাইক্রোপ্রোপাগেশনের ধাপ:
- এক্সপ্লান্ট সংগ্রহ: স্বাস্থ্যকর গাছের ক্ষুদ্র অংশ সংগ্রহ করা হয়।
- নিরীজন (Sterilization): ক্ষুদ্র অংশ জীবাণুমুক্ত করা হয়।
- পুষ্টিকর মাধ্যমের মধ্যে চাষ: টিস্যু নির্দিষ্ট পুষ্টিমিশ্রিত জেলে রাখা হয়।
- কেলাস গঠন (Callus Formation): কোষ বিভাজনের মাধ্যমে কলাস তৈরি হয়, যা পরে মূল ও কান্ড গঠন করে।
- হার্ডেনিং ও রোপণ: নতুন গাছটিকে ধাপে ধাপে প্রকৃত পরিবেশে স্থানান্তর করা হয়।
উদাহরণ:
- কলা, অর্কিড, অ্যালোভেরা (টিস্যু কালচারের মাধ্যমে প্রচুর সংখ্যায় উৎপাদিত হয়)।
উদ্ভিদজনিত বংশগতির গুরুত্ব
- নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ: অভিন্ন গুণাবলীর গাছ উৎপাদন নিশ্চিত হয়।
- দ্রুত বর্ধন: বীজ থেকে জন্মানো গাছের তুলনায় দ্রুত পরিপক্ক হয়।
- রোগমুক্ত গাছ: মাইক্রোপ্রোপাগেশনের মাধ্যমে স্বাস্থ্যকর গাছ তৈরি করা যায়।
- সম্পদ ব্যবহারের দক্ষতা: যে সমস্ত গাছ বীজ উৎপাদনে অক্ষম, তাদের জন্য কার্যকর।
উদ্ভিদজনিত বংশগতি উদ্ভিদের বংশবিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রাকৃতিক পদ্ধতি উদ্ভিদকে পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার সুযোগ দেয়, আর কৃত্রিম পদ্ধতি কৃষি ও বাণিজ্যিকভাবে উন্নতমানের গাছ উৎপাদনে সাহায্য করে। এই প্রযুক্তিগুলি উদ্ভিদ উৎপাদন, বিরল প্রজাতি সংরক্ষণ এবং টেকসই কৃষির উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখে।