ভূমিকা
পরিবর্তন (Evolution) হল এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে জীবদের মধ্যে ধাপে ধাপে পরিবর্তন ঘটে এবং সময়ের সাথে সাথে নতুন বৈশিষ্ট্যের উদ্ভব হয়। চার্লস ডারউইনের “প্রাকৃতিক নির্বাচন” (Natural Selection) তত্ত্ব বিবর্তন বিজ্ঞানের ভিত্তি স্থাপন করেছিল। তবে, ডারউইনের মূল তত্ত্বে কিছু ত্রুটি ছিল যা পরবর্তীকালে নব-ডারউইনবাদ (Neo-Darwinism) দ্বারা সংশোধিত হয়।
এই প্রবন্ধে আমরা নব-ডারউইনবাদের ধারণা এবং ডারউইনবাদের সীমাবদ্ধতা নিয়ে আলোচনা করব।
নব-ডারউইনবাদ: আধুনিক সংশ্লেষিত বিবর্তন তত্ত্ব
নব-ডারউইনবাদ কী?
নব-ডারউইনবাদ হল ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বের একটি আধুনিক সংস্করণ, যেখানে জেনেটিক্স, মিউটেশন এবং অণুজীববিদ্যা (Molecular Biology)-র তথ্য সংযোজন করা হয়েছে। বিশিষ্ট বিজ্ঞানী অগাস্ট ওয়েইসমান, রোনাল্ড ফিশার, জে. বি. এস. হ্যালডেন এবং সিওয়াল রাইট নব-ডারউইনবাদের বিকাশ ঘটিয়েছিলেন।
নব-ডারউইনবাদের মূলনীতি
নব-ডারউইনবাদ নিচের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা অন্তর্ভুক্ত করে:
ধারণা | বর্ণনা |
প্রাকৃতিক নির্বাচন | যেসব জীব উপযোগী বৈশিষ্ট্য বহন করে, তারা বেঁচে থাকে এবং বেশি সংখ্যায় বংশবৃদ্ধি করে। |
উৎপরিবর্তন (Mutation) | ডিএনএ-র আকস্মিক পরিবর্তন নতুন বৈশিষ্ট্যের সৃষ্টি করে। |
জেনেটিক পুনঃসংযোগ | যৌন প্রজননের ফলে পিতামাতার জিনের মিশ্রণ ঘটে, যা বৈচিত্র্য বৃদ্ধি করে। |
জিন প্রবাহ (Gene Flow) | বিভিন্ন জনসংখ্যার মধ্যে জিনের বিনিময় ঘটে, যা বিবর্তনের গতি বাড়ায়। |
জেনেটিক প্রবাহ (Genetic Drift) | ছোট জনসংখ্যায় জিনের সংখ্যা আকস্মিকভাবে পরিবর্তিত হতে পারে। |
বিচ্ছিন্নতা (Isolation) | কোনো প্রজাতি ভৌগোলিক বা অন্যান্য কারণে পৃথক হলে নতুন প্রজাতির উদ্ভব হয়। |
এইভাবে, নব-ডারউইনবাদ বিবর্তনের জেনেটিক ভিত্তি প্রদান করে, যা ডারউইনবাদের মধ্যে অনুপস্থিত ছিল।
ডারউইনবাদের সীমাবদ্ধতা ও ত্রুটি
চার্লস ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব যুগান্তকারী ছিল, তবে তার সময়ে জেনেটিক্স এবং অণুজীববিদ্যা সম্পর্কে তথ্য সীমিত থাকায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভুল থেকে গিয়েছিল। নিচে প্রধান কয়েকটি ত্রুটি আলোচনা করা হলো:
১. বৈচিত্র্যের (Variation) উৎস ব্যাখ্যার অভাব
ডারউইন শুধুমাত্র বলেছিলেন যে জনসংখ্যার মধ্যে বৈচিত্র্য থাকে, তবে তিনি ব্যাখ্যা করতে পারেননি নতুন বৈচিত্র্যের সৃষ্টি কীভাবে হয়। আধুনিক গবেষণায় জানা গেছে, উৎপরিবর্তন (Mutation) ও জেনেটিক পুনঃসংযোগ (Genetic Recombination)-ই নতুন বৈচিত্র্যের প্রধান কারণ।
২. বংশগতি (Heredity) ব্যাখ্যার অভাব
ডারউইন বিশ্বাস করতেন যে বংশগতি মিশ্র উত্তরাধিকার (Blending Inheritance) পদ্ধতিতে হয়, অর্থাৎ সন্তানরা মা-বাবার বৈশিষ্ট্যের গড় রূপ পায়। কিন্তু পরবর্তীকালে গ্রেগর মেন্ডেলের জেনেটিক উত্তরাধিকার তত্ত্ব (Mendelian Inheritance) প্রমাণ করে যে জিন (Gene) পৃথকভাবে পরবর্তী প্রজন্মে স্থানান্তরিত হয়।
৩. কেবলমাত্র প্রাকৃতিক নির্বাচনের উপর গুরুত্ব
ডারউইন বিবর্তনের একমাত্র মাধ্যম হিসেবে প্রাকৃতিক নির্বাচনকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু নব-ডারউইনবাদ দেখিয়েছে যে উৎপরিবর্তন, জিন প্রবাহ এবং জেনেটিক প্রবাহ-ও বিবর্তনের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
৪. উৎপরিবর্তনের ভূমিকাকে অগ্রাহ্য করা
ডারউইন বিবর্তনের ক্ষেত্রে উৎপরিবর্তনের কথা বলেননি, কারণ সে সময় উৎপরিবর্তনের ধারণা অজানা ছিল। আধুনিক বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে যে উৎপরিবর্তন হঠাৎ পরিবর্তন ঘটিয়ে নতুন বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি করতে পারে।
৫. নতুন প্রজাতি গঠনের ব্যাখ্যার অভাব
ডারউইন প্রজাতি গঠনের (Speciation) সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। আধুনিক গবেষণায় দেখা গেছে যে ভৌগোলিক, আচরণগত ও প্রজনন বিচ্ছিন্নতা নতুন প্রজাতির উদ্ভব ঘটাতে পারে।
ডারউইনবাদের ত্রুটি | নব-ডারউইনবাদের সংশোধন |
বৈচিত্র্যের উৎস ব্যাখ্যা করতে পারেনি | উৎপরিবর্তন ও জেনেটিক পুনঃসংযোগ দ্বারা বৈচিত্র্যের সৃষ্টি হয় |
বংশগতির ভুল ব্যাখ্যা দিয়েছিল | মেন্ডেলীয় বংশগতি তত্ত্ব জিনের প্রকৃত উত্তরাধিকার ব্যাখ্যা করে |
শুধুমাত্র প্রাকৃতিক নির্বাচনকে বিবর্তনের কারণ বলেছিল | অন্যান্য প্রক্রিয়া যেমন জিন প্রবাহ, জেনেটিক প্রবাহ বিবর্তনে ভূমিকা রাখে |
উৎপরিবর্তনের ভূমিকা বুঝতে পারেনি | উৎপরিবর্তন নতুন বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি করতে পারে |
নতুন প্রজাতির গঠনের ব্যাখ্যা ছিল অস্পষ্ট | বিচ্ছিন্নতার মাধ্যমে নতুন প্রজাতির উদ্ভব হয় |
চার্লস ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব বিবর্তন বিজ্ঞানের ভিত্তি তৈরি করেছিল, তবে এটি জেনেটিক্স ও অণুজীববিদ্যার অভাবে অসম্পূর্ণ ছিল। নব-ডারউইনবাদ এই ত্রুটিগুলি সংশোধন করে আধুনিক বিজ্ঞানের আলোকে বিবর্তনকে আরও সুসংহতভাবে ব্যাখ্যা করেছে।
বিজ্ঞান সর্বদা পরিবর্তনশীল এবং গবেষণার মাধ্যমে নতুন তথ্য যুক্ত হয়। নব-ডারউইনবাদ আমাদের দেখায় যে বিজ্ঞান কীভাবে পুরনো তত্ত্বের সীমাবদ্ধতাগুলি সংশোধন করে আরও উন্নত ও নির্ভুল ব্যাখ্যা প্রদান করে।