ভূমিকা
কোষ বিভাজন হলো জীবদেহের একটি মৌলিক প্রক্রিয়া, যা বৃদ্ধি, মেরামত, পুনর্জনন এবং সংরক্ষণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কোষচক্র (Cell Cycle) হলো কোষের বৃদ্ধির এবং বিভাজনের ধারাবাহিক পর্যায়।
কোষ বিভাজন প্রধানত তিনটি ভাগে বিভক্ত: অমাইটোসিস (Amitosis), মাইটোসিস (Mitosis) এবং মিয়োসিস (Meiosis)। প্রতিটি ধরনের কোষ বিভাজন জীবদেহের ভিন্ন ভিন্ন কাজ সম্পন্ন করে।
কোষ বিভাজনের প্রকারভেদ
১. অমাইটোসিস (Amitosis)
ঘটনাস্থল:
অমাইটোসিস সাধারণত এককোষী জীব, যেমন ব্যাকটেরিয়া, ইস্ট ও কিছু প্রোটোজোয়া-তে দেখা যায়। এটি বৃদ্ধ বয়সের কিছু কোষে, যেমন স্তন্যপায়ী প্রাণীর অস্থি-কলা (cartilage) ও বার্ধক্যজনিত কোষে-ও ঘটতে পারে।
অমাইটোসিসের বৈশিষ্ট্য:
- অমাইটোসিসে নিউক্লিয়াস সরাসরি বিভাজিত হয়, কোনো স্পাইন্ডল তন্তু (spindle fiber) গঠিত হয় না।
- নিউক্লিয়াসের জিনগত উপাদান অসমভাবে বিভাজিত হয়, ফলে অসম কোষ সৃষ্টি হয়।
- কোষের সাইটোপ্লাজম ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে দুটি নতুন কোষ তৈরি করে।
- এটি খুব দ্রুত ও কম শক্তি ব্যয়কারী একটি প্রক্রিয়া।
- সাধারণত নিয়ন্ত্রণহীন ও অনিয়মিত কোষ বিভাজন হিসেবে পরিচিত।
২. মাইটোসিস (Mitosis)
ঘটনাস্থল:
মাইটোসিস ঘটে দেহকোষ (somatic cells)-এ এবং এটি জীবদেহের বৃদ্ধি, কোষ মেরামত এবং কিছু ক্ষেত্রে অযৌন জনন (Asexual Reproduction)-এর জন্য দায়ী। এটি উদ্ভিদ ও প্রাণী উভয়ের মধ্যে ঘটে।
মাইটোসিসের বৈশিষ্ট্য:
- মাইটোসিসে দুটি সমান সংখ্যক (Diploid, 2n) কন্যা কোষ তৈরি হয়।
- এতে জিনগত উপাদান অপরিবর্তিত থাকে, অর্থাৎ মা-কোষ ও কন্যা-কোষ একই রকম হয়।
- মাইটোসিস চারটি পর্যায়ে সম্পন্ন হয়:
- প্রোফেজ (Prophase) – ক্রোমোজোম সংকুচিত হয়, নিউক্লিয়ার ঝিল্লি ভেঙে যায়, স্পাইন্ডল তন্তু তৈরি হয়।
- মেটাফেজ (Metaphase) – ক্রোমোজোম মধ্যরেখায় সারিবদ্ধ হয়।
- অ্যানাফেজ (Anaphase) – ক্রোমাটিডদ্বয় বিপরীত মেরুর দিকে চলে যায়।
- টেলোফেজ (Telophase) – নিউক্লিয়ার ঝিল্লি পুনরায় তৈরি হয় এবং সাইটোপ্লাজম বিভাজিত হয় (Cytokinesis)।
- এটি জীবদেহের উন্নয়ন, ক্ষত নিরাময় ও কোষ পুনর্নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ।
৩. মিয়োসিস (Meiosis)
ঘটনাস্থল:
মিয়োসিস ঘটে যৌন জননকারী জীবের জননকোষে (Germ Cells), যেমন পুরুষদের শুক্রাণু (Sperm) ও মহিলাদের ডিম্বাণু (Egg) এবং উদ্ভিদের পরাগরেণু (Pollen) ও ডিম্বক (Ovule) তৈরির সময়।
মিয়োসিসের বৈশিষ্ট্য:
- মিয়োসিসে চারটি জিনগতভাবে ভিন্ন কন্যা কোষ (Haploid, n) উৎপন্ন হয়।
- এটি দুটি ধারাবাহিক বিভাজনের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়:
- মিয়োসিস-I – সমসঙ্গত ক্রোমোজোম পৃথক হয়।
- মিয়োসিস-II – মাইটোসিসের মতোই, যেখানে বোন ক্রোমাটিড পৃথক হয়।
- এটি জিনগত বৈচিত্র্য সৃষ্টি করে, কারণ ক্রসিং ওভার (Crossing Over) এবং স্বতন্ত্র বিভাজন (Independent Assortment) ঘটে।
- মিয়োসিস যৌন জননের মাধ্যমে বংশগতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখে এবং জিনগত বৈচিত্র্য তৈরি করে।
অমাইটোসিস, মাইটোসিস ও মিয়োসিসের পার্থক্য
বৈশিষ্ট্য | অমাইটোসিস | মাইটোসিস | মিয়োসিস |
ঘটনাস্থল | এককোষী জীব, বৃদ্ধ কোষ | দেহকোষ | জননকোষ |
কন্যা কোষের সংখ্যা | দুইটি, অসম | দুইটি, অভিন্ন | চারটি, ভিন্ন |
ক্রোমোজোম সংখ্যা | অনিয়ন্ত্রিত | Diploid (2n) বজায় থাকে | Haploid (n) এ পরিণত হয় |
জিনগত বৈচিত্র্য | না | না | হ্যাঁ |
মূল উদ্দেশ্য | দ্রুত বিভাজন, অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি | বৃদ্ধি, মেরামত, অযৌন জনন | যৌন জনন, জিনগত বৈচিত্র্য তৈরি |
কোষ বিভাজন জীবদেহের অস্তিত্ব ও বংশধর সৃষ্টি করার জন্য অত্যাবশ্যক। অমাইটোসিস সাধারণত এককোষী জীব ও বার্ধক্যজনিত কোষে ঘটে, মাইটোসিস জীবদেহের বৃদ্ধি ও মেরামতের জন্য দায়ী, এবং মিয়োসিস যৌন জননের মাধ্যমে নতুন বৈচিত্র্যময় প্রজন্ম তৈরি করে। এই প্রক্রিয়াগুলি জিনতত্ত্ব, বিবর্তন এবং কোষবিজ্ঞানের মূল ধারণাগুলি বোঝার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।